খাদ্য বিষক্রিয়ায় হাইড্রোজ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বিকল্প
প্রফেসর ড. মারুফ আহমেদ১ মোছা: ইমা পারভীন২ মোঃ শাহজাহান কবির৩
বেঁচে থাকার জন্য সবার আগে প্রয়োজন খাদ্যের। মৌলিক চাহিদার প্রথমটিই খাদ্য। খালি চোখে না দেখা অণুজীব থেকে শুরু করে বৃহদাকার নীল তিমি পর্যন্ত প্রত্যেকের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন খাবার। কিন্তু বর্তমানে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যই যেন হয়ে উঠেছে মানুষের জীবননাশের কারণ। শুধুমাত্র অল্পকিছু মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অননুমোদিত কেমিক্যাল, খাদ্য হচ্ছে ভেজালযুক্ত, বাড়ছে বিষক্রিয়া, বৃদ্ধি পাচ্ছে বিভিন্ন রোগ ব্যাধি, কমছে আয়ু।
ভেজাল, ভেজাল, ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়,
ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস মিলবে নাকো চেষ্টায়।
খাঁটি জিনিস এ কথাটা রেখো না আর চিত্তে,
ভেজাল নামটা খাঁটি কেবল, আর সকলই মিথ্যে।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা যেন বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্য পরিস্থিতির স্পষ্ট চিত্রই তুলে ধরে। বর্তমান নাগরিক জীবনের অন্যতম উদ্বেগের নাম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি ভেজাল খাবার। মজাদার খাবার এখন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা রাজধানীসহ, জেলাশহর, উপজেলাশহর, হাটবাজারগুলোতে বিভিন্ন মিষ্টি ও বেকারি খাবারে ব্যবহার করছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নিষিদ্ধ হাইড্রোজ, যার রাসায়নিক নাম সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। হাইড্রোজ গার্মেন্ট শিল্পে কাপড়ের রঙ সাদা করতে ব্যবহার করার কথা থাকলেও বর্তমানে কতিপয় অর্থলোভী ব্যবসায়ী ব্যবহার করছে খাদ্য সাদা বা পরিষ্কার রাখতে। ফলে খাদ্য হচ্ছে বিষাক্ত।
হাইড্রোজের ব্যবহার : হাইড্রোজ সাধারণত ব্লিচিং এজেন্ট ও রিডিউসিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে। সাধারণত গার্মেন্ট শিল্পে কাপড়ের এবং কাগজ শিল্পে কাগজের ম-ের রঙকে উজ্জ্বল করতে হাইড্রোজ ব্যবহার হয়।
বাংলাদেশে যে খাবারগুলোতে অননুমোদিতভাবে হাইড্রোজ ব্যবহার হচ্ছে তা হলো : মুড়ি সাদা করতে; চালের রঙ উজ্জ্বল করতে; গুড়ের রঙ উজ্জ্বল করতে; জিলাপি মুচমুচে করতে; মোরব্বা সাদা ও শক্ত করতে; মিষ্টির রঙ সাদা করার জন্য; কেক নরম ও আকর্ষণীয় করতে; আটা-ময়দার মধ্যেকার জ্যান্থফিলের রঞ্জক কে কমিয়ে সাদা রঙ এ পরিবর্তন করতে; রসগোল্লা তেলে ভাজার পর হাউড্রোজ মিশ্রিত চিনির সিরায় ছেড়ে দিলে তা ধবধবে সাদা হয়; ময়দার তৈরি বিস্কুট সাদা করার জন্য তালমিছরি নামে সাদা ধবধবে এক ধরনের চিনির তৈরি মিষ্টিদ্রব্য সাদা করতে ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজ।
ক্ষতিকর প্রভাব : খাদ্যে হাইড্রোজ ব্যবহার করলে তা জারিত হয়ে বিষাক্ত সালফার-ডাই-অক্সাইড তৈরি করে যা মানুষের শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে হাইড্রোজ শরীরে ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে যা বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, নিষিদ্ধ হাইড্রোজ প্রয়োগের ফলে ক্যান্সার, হাঁপানি এবং চর্মরোগ হয়। দ্রবণটিকে ৪-৫ ঘণ্টার জন্য স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দিতে হবে। যদি সেই খাবারের মধ্যে হাইড্রোজ উপস্থিত থাকে তাহলে পাত্রের তলায় ধূসর বর্ণের অধক্ষেপ পড়বে। সংগঠিত বিক্রিয়াটি নিম্নরূপ :
২ঈঁঝঙ৪+ঘধ২ঝ২ঙ৪=২ঈঁঙ (অধক্ষেপ) + ঘধ২ঝ২ঙ৬+২ঝঙ২
এ ছাড়াও অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহার করে খাদ্যে উপস্থিত হাইড্রোজের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব।
হাইড্রোজের বিকল্প ব্যবহার ও জনসচেতনতা : যদিও হাইড্রোজের সরাসরি বিকল্প নেই বললেই চলে তবে পটাশিয়াম মেটা বাইসালফাইট, সোডিয়াম মেটা বাইসালফাইট অনেকটা হাইড্রোজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। যদিও এই ব্যাপারে আরো বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন আছে।
আমাদের সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করতে হবে। একে বাস্তবায়িত করতে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই সর্বাগ্রে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্য এবং এসবের জোগানদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
খাদ্যের নমুনা পরীক্ষা করার জন্য প্রত্যেক জেলায় এবং বড় বড় বাজারগুলোতে পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে। ইঝঞও ও ইধহমষধফবংয ঋড়ড়ফ ঝধভবঃু অঁঃযড়ৎরঃু সহ বিভিন্ন সংস্থাকে এই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। ভেজাল বিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং বাজার তদারকির জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ভোক্তাপর্যায়ে সবাইকে খাবার ক্রয়ের আগে সেই খাবার সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হবে। ক্রেতাপর্যায়ে খাবারের চাকচিক্য না দেখে খাবারের গুণাবলী ও পুষ্টিগুণ দেখে খাবার ক্রয়ের জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
ব্যবসায়ীদের খাদ্যদ্রব্যে হাইড্রোজ মিশানোর ভয়াবহ দিক সম্পর্কে জানিয়ে তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার প্রয়াস চালাতে হবে। একই সাথে সরকারিভাবে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও সঠিক বাজার তদারকির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : ১ডিপার্টমেন্ট অব ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজারভেশন, হাবিপ্রবি, দিনাজপুর; ২,৩ বিএসসিইন ফুড অ্যান্ড প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং, চতুর্থ বর্ষ, হাবিপ্রবি, দিনাজপুর; মোবাইল : ০১৭৫০৭৭৭৮৯৯, ই-মেইল : maruffpp@gmail.com.